স্বপ্নের ক্যারিয়ার সাজাই

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - জীবন ও জীবিকা - Life and Livelihood - | NCTB BOOK
26
26

স্বপ্নের ক্যারিয়ার সাজাই

মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে- নানা রঙে, নানা মাত্রায়। স্বপ্ন দেখার এই শক্তি একমাত্র মানুষের মাঝেই রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এখানেই মানুষের পার্থক্য। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ, যে নিজের মতো করে ভাবতে পারে, নিজের পছন্দমতো স্বপ্ন দেখতে পারে এবং তা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। তাই আগামী দিনগুলোতে যে পরিবর্তন আসবে, তার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য এখন থেকেই আমাদের পথ পরিক্রমা সাজাতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য কোন পেশা অপেক্ষা করছে, তা আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4IR-Fourth Industrial Revolution) সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তির কল্যাণে এবং গ্রিন পরিবেশ ও টেকসই অর্থনীতির প্রয়োজনে ভবিষ্যতে অনেক নতুন পেশা বা কর্মক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্র ও সুবিধা সম্পর্কে জানা এবং নিজেদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। একটি সফল কর্মজীবনের পথ তৈরি করার জন্য এসব পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে আমাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে।

ক্যারিয়ার ভাবনা

আমরা প্রায় সবাই নাসার কথা শুনেছি। সৌরজগতের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ঘাঁটি হচ্ছে নাসা (NASA-National Aeronautics and Space Administration) | এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও সৌরজগৎ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে। আজ নাসার একজন বিজ্ঞানীর গল্প শুনব।

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠে শাহনাজ। ছোটোবেলায় খেলাধুলায় মনোযোগী ছিলেন। আঁকাআঁকি করতেও বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু রাতের আকাশ দেখা ছিল তার প্রিয় কাজের একটি। মাধ্যমিকে পড়ার সময় সায়েন্স ফিকশন ও পদার্থবিদ্যায় তৈরি হয় তার প্রবল আগ্রহ। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তাই ভর্তি হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন শাহনাজ এবং তার সঙ্গে পড়ুয়া আরও অনেকে। পরপর তিনবার অংশগ্রহণ করেও তাদের টিমের পুরস্কার পাওয়া আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাতে নিজের ওপর আস্থা হারাননি শাহনাজ। হতাশাকেও ঠাঁই দেননি মনের কোণে; বরং একেকটি হার যেন তার জন্য একেকটি অনুপ্রেরণা। প্রতিটি প্রতিযোগিতার পর সবাই মিলে নিজেদের ঘাটতি আর কী কী ভুল ছিল, কীভাবে ভুলগুলো শুধরানো যায়, প্রজেক্টের কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল ইত্যাদি খুঁজে বের করেন এবং এরপর নতুনভাবে প্রজেক্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন।

মহাজাগতিক রেডিয়েশন মহাকাশে আলোর গতিতে চলা উচ্চশক্তির প্রোটন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াস থেকে সৃষ্ট বিকিরণে প্রভাবে সৃষ্ট একধরনের পরিস্থিতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা মহাকাশচারীদের জন্য তৈরি করেন এক বিশেষ পোশাক। তাঁদের এই প্রজেক্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অনেক দেশকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। এরপর তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিকসে মহাশূন্য, শক্তির বিকিরণ, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা পড়াশোনার জন্য বৃত্তি (স্কলারশিপ) পেয়ে বিদেশের মাটিতে শুরু করেন তার গবেষণা জীবন। গবেষণাকালেই তিনি টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। দক্ষতা ও কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে নাসায় কাজ করার অনন্য সুযোগ এনে দেয়। বর্তমানে শাহনাজ নাসায় একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন, যা ছিল তাঁর একসময়কার স্বপ্ন! ছোটোবেলা থেকেই সায়েন্স ফিকশন এবং বিজ্ঞান চর্চায় অনুরক্ত শাহনাজের কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের পৃথিবীকে জানার যে যাত্রা, তা ছিল অসাধারণ। শাহনাজ এখন দীক্ষিত হয়েছেন নাসায় প্রচলিত 'এখানে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই' এই মন্ত্রে।

ক্যারিয়ারের ধারণা

সাধারণভাবে বলা যায়, জীবনের সুনির্দিষ্ট কর্মময় অংশই হলো ক্যারিয়ার। সারা জীবন একজন মানুষ তার পেশা-সংক্রান্ত যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তা-ই হলো তার ক্যারিয়ার। কারিয়ার স্থির কিছু নয়, বরং পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান। সবাই কামনা করেন, তার ক্যারিয়ারের এই পরিবর্তন বা বিকাশ যেন নিজের সাজানো লক্ষ্য অনুযায়ী হয়। ক্যারিয়ার সুন্দরভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাইকে বিশেষ কিছু দিক লক্ষ রাখতে হয়:

ক) নিজের দক্ষতা এবং আগ্রহ ভালোভাবে জেনে নেওয়া: যেকোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে নিজেকে জানা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আমরা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে 'কাজের মাঝে আনন্দ', 'কী আছে আমার মাঝে', 'আমার জীবন আমার লক্ষ্য' ইত্যাদি অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন মজার কাজের (অ্যাক্টিভিটি) মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কাজের প্রতি আগ্রহ, মনোযোগ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজের দক্ষতা আছে কি না, সে বিষয়টিও ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখে। আমরা সাধারণত যেসব কাজ করতে ভালোবাসি, তা যদি জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে করি, তাহলে সেই কাজ বা ক্যারিয়ার নিশ্চয়ই আনন্দময় হয়ে উঠবে।

খ) বিভিন্ন ধরনের পেশা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা: নিজের পছন্দ বা দক্ষতা অনুযায়ী আমরা যা করতে চাই, তা খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের পেশা, বৃত্তি, কাজ বা চাকরি সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে। কোন ধরনের পেশার কাজ কী, সেগুলোতে কী ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। এগুলো জানা থাকলে নিজের কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করা বা খুঁজে বের করা সহজ হবে।

গ) লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন: ক্যারিয়ারের গতি বা বিকাশ চলমান রাখার জন্য এবং সফল ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অপরিহার্য। লক্ষ্য বা গন্তব্য স্থির করা না থাকলে অনেক সময় দেখা যায়, নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সফল ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। লক্ষ্য নির্বাচন করা হলে সেই অনুযায়ী কোন পর্যায়ে কী কী কাজ করতে হবে, কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কোন ধরনের প্রশিক্ষণ কখন করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ক পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়। এজন্যই ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করার কৌশল আমরা পূর্বের শ্রেণিতে অনুশীলন করেছি।

ঘ) সংশ্লিষ্ট চাকরি বা কাজের ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা: বিভিন্ন গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চাকরির খোঁজ পাওয়া যায়। ক্যারিয়ার গঠনে এসব খোঁজ রাখা বা অনুসন্ধান করা খুব জরুরি। তবে এক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন। নিজের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কি না, বা এটি করার আগ্রহ আছে কি না এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কি না- এই বিষয়গুলো ধৈর্য সহকারে খুঁজে দেখতে হবে।

ঙ) সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র বা চাকরি পরিবর্তন: ক্যারিয়ারের এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আমরা জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরন ও চাকরির ক্ষেত্র বদলায়। সুতরাং সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা খুব জরুরি। এ কারণে ক্যারিয়ারকে আরও সুগঠিত ও সাফল্যময় করার জন্য সময় ও সুযোগ অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়। নিজের নতুন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও সুবিধাজনক চাকরি খুঁজে বের করা আমাদের ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রারই একটি অংশ।

মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড সুপার আমাদের ক্যারিয়ার জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যা life rainbow নামে পরিচিত। এখানে সময়ের সঙ্গে মানুষের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে পরিবর্তন ও স্থিতি দেখা যায়, তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে পেশার রূপান্তর

ক্যারিয়ার নির্বাচনের জন্য বিদ্যমান পেশা, কাজের ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতে এসব পেশা ও কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ও রূপান্তর আসতে পারে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। বিভিন্ন খাতের পেশা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে কিছু তথ্য জেনেছি; এখন আমরা আগামীর সম্ভাব্য পেশা সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করব। আমরা ফার্নিচার শিল্পে একসময় কাঠ রানদা করতে দেখেছি। কাঠমিস্ত্রি অনেক কষ্ট করে হাতে রানদা টেনে কাঠ পলিশ করতেন। আর এখন এসেছে কাঠ ফিনিশিং মেশিন বা উড প্ল্যানার মেশিন। যার ফলে অল্প সময়ে মেশিনে অনেক বেশি কাঠ পলিশ করা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এরকম হাজারো প্রযুক্তির আগমন সব পেশাতেই নিয়ে এসেছে যুগান্তকারী রূপান্তর।

মজার বিষয় হলো, কোন পেশাগুলো পূর্বে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে; আবার কোনগুলো বিলুপ্ত হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের দেশে একটি গবেষণা হয়েছে, সেখানে পেশার অতীত, বর্তমান এবং রূপবদল নিয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, ফার্নিচার, এগ্রো প্রসেসিং, লেদার এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি- এই পাঁচটি সেক্টরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে। গার্মেন্টস এবং ফার্নিচার সেক্টরে শতকরা ৬০ ভাগ পেশা (বর্তমানে চলমান) ঝুঁকির মধ্যে আছে। পাশাপাশি এগ্রো ৪০ ভাগ, লেদার ৩৫ ভাগ এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটির ক্ষেত্রে ২০ ভাগ পেশা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই পেশাগুলোর কিছু আংশিক বদলে যাবে, কিছু রূপ বদল হবে, আবার কিছু একবারে বন্ধ হয়ে যাবে।

অনানুষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টের দিকে তাকালে দেখতে পাই, জিডিপিতে শিল্প ও পরিষেবার সম্মিলিত অবদান ৮৮ শতাংশ, যেখানে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান রয়েছে। জীবন ও জীবিকার দিক থেকে অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বলতে ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা চাকরির এক অর্থনৈতিক খাতকে বোঝায়, যা সরকার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা সুরক্ষিত নয়। যেমন: নিজের জমি, দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ, গৃহস্থালি কাজ, হকারি, দিনমজুরি প্রভৃতি।

অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার হলো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত, যেখানে সময় ও শ্রম পরিমাপের ভিত্তিতে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ন্ত্রিত হয়। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে কাজের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, মজুরি, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি অনেকাংশে নির্ধারিত থাকে। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন: উন্নয়ন পরিকল্পনা, কর্মপরিকল্পনা, ভর্তুকি ইত্যাদি থাকে। আবার অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরাসরি এ ধরনের উদ্যোগ না থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনে নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন: করোনার সময়ে আমরা দেখেছি, সরকার কৃষকদের বিশেষ ভর্তুকি দিয়েছে।

কিন্তু এই শ্রমবাজার কয়েক বছর ধরে ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্কিলস গ্যাপ, অফিস অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গিগ ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সমন্বয় ইত্যাদি কারণে এই শ্রমবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। শ্রমবাজারে অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যেমন:

অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)

অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত অগ্রগতি শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন কাজ, বারবার করতে হয় এমন কাজ যন্ত্রনির্ভর বা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যেতে পারে, যা নির্দিষ্ট শিল্পে শ্রমবাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নতুন যে সুযোগ তৈরি হবে, তা হলো রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ার, এআই ডেভেলপার এবং ডেটা বিশ্লেষণের মতো ক্ষেত্র।

স্কিলস শিফট

প্রত্যাশা করা হচ্ছে অটোমেশন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্রই দক্ষতার চাহিদার পরিবর্তন হবে। শ্রমবাজার ক্রমবর্ধমানভাবে নতুন দক্ষতা এবং ইনোভেশনকে সমর্থন জানাবে। বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা শ্রমবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

গিগ ইকোনমি এবং যেকোনো জায়গা থেকে কাজ

মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্য একটি বিশেষ দিক হলো গিগ ইকোনমি। এর ফলে পূর্ণসময় কাজের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি চুক্তি এবং স্বাধীনভাবে ফ্রিল্যান্সারদের কাজের বাজার প্রসারিত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যেকোনো জায়গায় বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারে নতুন মাত্রা ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

শ্রমবাজার মেরুকরণ

আমরা দেখছি, শ্রমবাজার মেরুকরণের সম্মুখীন হচ্ছে, যার অর্থ হলো উচ্চ-দক্ষতা এবং নিম্ন-দক্ষতার প্রাধান্য পাচ্ছে শ্রমবাজারে। কাজগুলো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে, পাশাপাশি মধ্যম দক্ষতার শ্রমবাজার হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ-দক্ষ কাজের ক্ষেত্রের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অদক্ষ বা কম দক্ষতার কাজগুলো অটোমেশনের প্রতিযোগিতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে।

গ্রিন জব এবং টেকসইকরণ

এসডিজির উন্নয়নে শ্রমবাজার এখন গ্রিন জব এবং টেকসইকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা, কাজের স্থায়িত্ব, সবুজ অর্থনীতি, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ, টেকসই কৃষি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে কাজের সুযোগ তৈরি হবে আগামীর শ্রমবাজারে।

বয়স্ক শ্রমশক্তি

পৃথিবীর অনেক দেশই বার্ধক্যজনিত শ্রমশক্তির সম্মুখীন হচ্ছে, যা আগামীর শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করবে। এসব দেশের বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা, কেয়ারগিভিং এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের প্রয়োজন হবে। ফলে এ ধরনের শ্রমবাজারের জন্য দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তি তৈরির উদ্যোগ জরুরি।

গ্লোবালাইজেশন এবং ডিজিটালাইজেশন

গ্লোবালাইজেশন এবং ডিজিটালাইজেশন শ্রমবাজারে নতুন রূপ আসছে। কোম্পানিগুলো ক্রমেই ডিজিটাইজ হচ্ছে, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করছে, সৃজনশীল ও দক্ষ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং আমরা একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হচ্ছি। তাই বলা যায়, এই প্রবণতা বিশ্ব প্রতিযোগিতাকে তীব্র করে তুলতে পারে এবং বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তিই আগামীর শ্রমবাজারে টিকে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযোজনযোগ্যতা, ক্রমাগত দক্ষতার বিকাশ, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবন আগামীর শ্রমবাজারে প্রভাব বিস্তার করবে।

বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমবাজার বিভিন্ন খাত নিয়ে গঠিত যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ কৃষি, সেবা, শিল্প ইত্যাদি খাতে রয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, 4IR প্রযুক্তি কর্মদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেবে, যা শ্রমবাজারকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। এই পরিবর্তনগুলো নেভিগেট করার জন্য ডিজিটাল দক্ষতায় আপস্কিলিং এবং রিস্কিলিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনী চর্চা নতুন সুযোগ তৈরি করবে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (4IR), শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শ্রমবাজার এবং শ্রমের চাহিদার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন আমরা আমাদের বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য প্রভাব (প্রজেকশন) কেমন হতে পারে, তার সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।

কৃষি খাত

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। শস্য চাষ, পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রযেছে। এই খাতে নতুন জাতের উন্নয়ন, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা, আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামো এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। স্বল্প খরচ বা বিনিয়োগের পেশা হিসেবে কৃষিতে কিছু নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হতে যাচ্ছে। 4IR প্রযুক্তি প্রসারের ফলে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে, ফসল-পরবর্তী ক্ষতি কমে আসবে এবং সম্পদের ব্যবহার সুনির্দিষ্ট হবে। প্রযুক্তি উন্নত জাত, IoT সেন্সর স্প্রে ও বালাইনাশক, ডেটা বিশ্লেষণ, ফসল পর্যবেক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা এবং ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করবে। ফলে কৃষিপ্রযুক্তি এবং তথ্য বিশ্লেষণে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা যেমন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে কায়িক শ্রমের চাহিদা কমতে পারে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন উদ্ভূত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায়ে বৃক্ষরোপণ, অর্গানিক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নার্সারি স্থাপন, নতুন প্রজাতি উদ্ভাবনের প্রযুক্তি, অর্নামেন্টাল ট্রি, ফিশ চাষ ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।

শিল্প খাত

গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল

গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্প বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেখানে শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম এবং রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ (প্রায় ৮২ ভাগ) এ খাত থেকে আসে। এখানে গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং, স্টিচিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। 4IR প্রযুক্তি যেমন: অটোমেশন, রোবোটিকস এবং ডেটা অ্যানালিটিকস গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অটোমেশন প্রোডাকশন অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে এবং শ্রম-নির্ভর কাজের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। আবার প্রযুক্তি, প্রোগ্রামিং এবং ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু অটোমেশনের কারণে এই খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে যাচ্ছে অদক্ষ এবং অল্প দক্ষ শ্রমিকদের নিয়ে, তাঁদের চাকরি হারানোর উদ্বিগ্নতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমাদের এই শিল্পে আগতদের সম্ভাব্য দক্ষতা অর্জন করা জরুরি।

নির্মাণ ও অবকাঠামো

নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতটি অন্য একটি জনপ্রিয় খাত, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনমজুর থেকে শুরু করে কারিগরি, সাধারণ, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরির যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের কাজের সুযোগ এখানে রয়েছে। এই খাতেও এখন লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া, দিন দিন আমরা যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। 4IR এর কারণে যেসব প্রযুক্তি, যেমন: বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং (বিআইএম), ড্রোন এবং প্রিফেব্রিকেশন নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা উন্নত করে খরচ কমিয়ে আনবে। বিআইএম মডেলিং, ড্রোন অপারেশন এবং ডিজিটাল প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যাবে। নির্মাণ কার্যক্রমে অটোমেশন এবং রোবোটিকস চালু হওয়ায় কায়িক শ্রমের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে। ফলে মেশিন অপারেশন-সংক্রান্ত পেশার চাহিদা বাড়বে।

ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যানুফ্যাকচারিং

বাংলাদেশ স্বয়ংচালিত ইলেকট্রনিকস, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং এবং উৎপাদন শিল্পের দিক থেকে এই ক্ষেত্র বিবেচনা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন, ম্যানুফ্যাকচারিং অপারেশন, মানের নিশ্চয়তা এবং রক্ষণাবেক্ষণে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।

ফার্মাসিউটিক্যালস

বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বিদেশে নিয়মিত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। তাছাড়া এর কলেবর ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফার্মাসিউটিক্যালের ক্ষেত্রে উৎপাদন, গবেষণা ও উন্নয়ন, মান  নিয়ন্ত্রণ, বিক্রয় প্রতিনিধি এবং বিপণনে কর্মসংস্থানের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 4IR এর কল্যাণে সঠিক ওষুধ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল স্ক্যানিং, সঠিক রোগ নির্ণয়, রোবট অপারেশন এবং এআইনির্ভর ওষুধ আবিষ্কারের মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে বিপ্লব ঘটতে পারে। বায়োইনফরমেটিকস, ডেটা বিশ্লেষণ, ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল বিপণন এবং উদ্ভাবকদের চাহিদা ও কদর বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) এবং আউটসোর্সিং

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইটি খাত বিশেষ করে আউটসোর্সিং দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ খাতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, আইটি সাপোর্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)-এ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। 4IR-এর সবচেয়ে বড় ঢেউ আইটি সেক্টরে লেগেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং, এআর, ভিআর, ব্লকচেইন, বিগডাটা এবং সাইবার নিরাপত্তার মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো এই সেক্টরকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে। এই সেক্টরে AI, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স এবং সাইবার সিকিউরিটিতে দক্ষ পেশাদারদের কদর আগামীতে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

সেবা খাত

অর্থনৈতিক সেবা

বাংলাদেশের আর্থিক সেবা খাতের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং, বীমা, পুঁজিবাজার এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান। এই খাতে ব্যাংকিং কার্যক্রম, গ্রাহক পরিষেবা, আর্থিক বিশ্লেষণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং বৃদ্ধি এবং সুবিধাবঞ্চিত জনসংখ্যার অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে খাতটি প্রসারিত হচ্ছে। 4IR কেন্দ্রিক প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই সেক্টরে উদ্ভাবন, যেমন: মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট, রেমিট্যান্স প্রেরণ, ক্যাশবিহীন লেনদেন ব্যাপক হরে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে ব্লকচেইন প্রথাগত ব্যাংকিং অনুশীলনকে নতুন রূপ দেবে। আর্থিক প্রযুক্তি, ডেটা অ্যানালিটিকস এবং সাইবার সিকিউরিটিতে দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদারদের চাহিদা বাড়বে, যেখানে নগদ হ্যান্ডলিং এবং কাগজভিত্তিক ম্যানুয়াল কাজের চাহিদা হ্রাস পাবে। তাই এই খাতে প্রযুক্তিগত ব্যবহার, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত পেশার প্রসার বৃদ্ধি পাবে।

স্বাস্থ্যসেবা

অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের অন্য একটি বড় খাত হলো স্বাস্থ্যসেবা। এখানে ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ, ফার্মাসিস্ট এবং প্রশাসনিক কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়ছে। স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এই বাজারের পরিধি বাড়ছে। 4IR প্রযুক্তি বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিপ্লব বয়ে আনবে। টেলিমেডিসিন, ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড, এআই-চালিত ডায়াগনস্টিকস, অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতাগুলো সমৃদ্ধ হবে। স্বাস্থ্য তথ্য, তথ্য বিশ্লেষণ, টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, ইয়োগা, মেডিটেশন ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা আগামীতে বাড়বে।

ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি

ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি খাতটি বিভিন্ন কারণে শ্রমবাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশ্বের বড় সমুদ্রসৈকত, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এই খাতের উল্লেখযোগ্য 

সম্ভাবনা রয়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর এবং ইকোট্যুরিজম ইত্যাদি উদ্যোগের কারণে এ খাতে কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। 4IR প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইন ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ এবং ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি অভিজ্ঞতা এই খাতকে নতুন রূপ দিতে পারে। প্রযুক্তি ইন্টিগ্রেশনের ওপর ফোকাসসহ ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাহক অভিজ্ঞতা ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাভেল ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বাড়তে পারে।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাত উল্লেখযোগ্য। এই সেক্টরে শিক্ষাদান, শিক্ষা প্রশাসন, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, সুপারভিশন, মনিটরিং-মেন্টরিং, বৃত্তিমূলক ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। 4IR এর প্রযুক্তির কল্যাণে সিনক্রোনাস এবং এসিনক্রোনাস লার্নিং, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, সিমুলেশনের ব্যবহার, অনলাইন মূল্যায়নপদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে। ব্লেন্ডেড শিক্ষার প্রচলন বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষাগত প্রযুক্তি, কারিকুলাম ডিজাইন এবং অনলাইন শিক্ষাদানে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষক এবং শিক্ষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বাড়বে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ

টেকসই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ যেকোনো দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল শ্রমবাজার। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। 4IR এর প্রযুক্তির কারণে স্মার্ট গ্রিড, রিনিউয়েবল পাওয়ার সিস্টেম এবং পাওয়ার ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্ট গ্রিড পরিচালনায় দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদারদের চাহিদা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ এবং ম্যানুয়াল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শ্রমশক্তির চাহিদা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

টেলিযোগাযোগ

টেলিযোগাযোগ খাত দ্রুত বর্ধনশীল একটি খাত, যা মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিপ্লবের কারণে সম্ভব হয়েছে। টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো, নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট, গ্রাহক সহায়তা, ডিজিটাল পরিষেবা ইত্যাদি পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ অবারিত। টেলিযোগাযোগ খাতে 4IR-এর প্রযুক্তি যেমন: 5G, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং ভার্চ্যুয়াল কমিউনিকেশন প্ল্যাটফর্মের মতো ক্ষেত্রগুলোকে নতুন রূপ দেবে। নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা অ্যানালিটিকস এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বেড়ে যাবে।

পরিবহণ

আমাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ ও সাবলীল করে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি এনেছে পরিবহণ খাত। পরিবহণ ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক অপারেশন, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের মতো ক্ষেত্রগুলোতে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। 4IR এর কারণে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন, সাপ্লাই চেইন অপ্টিমাইজেশন এবং রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং সিস্টেম উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবহণ এবং লজিস্টিক সেক্টর রূপান্তরিত হবে। ফলে লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট, ডেটা অ্যানালিটিকস, সাপ্লাই চেইন অপ্টিমাইজেশন এবং অটো যানবাহন অপারেশনে দক্ষ ব্যক্তিরা আগামীতে এই খাতে নেতৃত্ব দেবেন।

আর্থিক প্রযুক্তি (ফিনটেক)

প্রযুক্তিভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল সল্যুশন বা ফিনটেক ডিজিটাল পেমেন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং ব্লকচেইন, আর্থিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ই-কমার্সে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে। এই খাতের উন্নয়নের ফলে আর্থিক পরিষেবার রূপান্তর যেমন হয়েছে, তেমনি পেশাদারদের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ও পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে পরিচয়

বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে কাজের বাজার দ্রুত বদলাচ্ছে। কাজের যোগান, চাহিদা, কাজের চরিত্রে পরিবর্তন ও মজুরি সবই প্রচলিত ধারণা থেকে সরে যাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে আসছে বিশাল এই পরিবর্তন। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের ধারায় ২০৩০ বা ২০৪১ সালের শিল্পব্যবস্থায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির স্থানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (WEF) তাদের গবেষণায় বলেছে, সারা বিশ্বের বর্তমানে প্রচলিত পদ-পদবিগুলোর মধ্য থেকে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারিয়ে যাবে এবং নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ও অতিদক্ষ মানবসম্পদের শ্রমবাজার যেমন সম্প্রসারিত হয়েছে তেমনি অদক্ষ শ্রমের বাজার দিন দিন হচ্ছে সংকুচিত।

ধীরে ধীরে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছি। এ সময়ে অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। বিশ্ব শ্রমবাজারের কর্মক্ষেত্রের দিকে তাকালে যেসব পেশার সম্ভাবনা দেখতে পাই-

প্রযুক্তি এবং ডেটানির্ভর পেশা: মেশিন লার্নিং, অটোমেশন, রোবোটিকস এবং ডেটা সায়েন্সের ক্ষেত্রে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বাড়ছে। সকল দেশেই ডেটা-বিশেষজ্ঞ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতো পেশাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সৃজনশীল ডিজাইন-সম্পর্কিত পেশা: বিশ্বব্যাপী সৃজনশীল দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কাজের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রাফিকস ডিজাইন, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন, অ্যানিমেশন, ভিজ্যুয়াল ডিজাইন তৈরির মতো পেশাগুলো দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকবে।

উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন: শুধু চাকরির প্রত্যাশায় বসে না থেকে বিভিন্ন ধরনের পেশার দিকে মানুষ ধাবিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন ছাড়া নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং উক্ত সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করা ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের জন্য অপরিহার্য।

স্বাস্থ্যসেবা এবং জৈবপ্রযুক্তি: রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাপদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটে চলছে। ফলে বিশ্বজুড়ে টেলিমেডিসিন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োইনফরমেটিকসের মতো পেশাগুলো বাড়ছে। উক্ত পেশায় পেশাদারদের সহানুভূতি ও যোগাযোগের দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশ সাশ্রয়ী উদ্ভাবন: সুন্দর পরিবেশ আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য। তাই সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবেশগত প্রকৌশল, টেকসই কৃষি এবং নগর পরিকল্পনা-সম্পর্কিত পেশাগুলো সারা বিশ্বে প্রাধান্য পাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের প্রভাব

বৈশ্বিক শ্রমবাজারে পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই বৈশ্বিক শ্রমবাজারের পরিবর্তনের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সেখানে কোন ধরনের নিরাময়ব্যবস্থা বা প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া প্রয়োজন, তা এখনই ভাবতে হবে। সে প্রস্তুতির জন্য আমাদের স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন; যার মাধ্যমে আগামীর বিশ্বে আমাদের অবস্থান আরও সংহত করতে পারি। কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা দেখে নেওয়া যাক-

পেশার ক্ষেত্রে মৌলিক দক্ষতা ও গুণাবলি

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আগামীতে যখন চাকরির অনেক ক্ষেত্র হারিয়ে যাবে, তখন আমরা কীভাবে নিজের জন্য চাকরি খুঁজে বেড়াব? অথবা নিজেকে কোন কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করব? এরকম একটি পরিবেশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো একটি দক্ষতা নয়; বরং এমন কিছু মৌলিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যাতে নতুন যে ধরনের পেশাই আসুক না কেন, নিজেকে সেখানে মানিয়ে নিতে পারবে। মৌলিক দক্ষতা বলতে আমরা কী বুঝি? পেশার মৌলিক দক্ষতা হলো ব্যক্তির নিজস্ব কিছু যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা, যার সাহায্যে পেশার কাজগুলো সুনিপুণভাবে করা যায় এবং যা পেশাগত সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। এবার আমরা পেশার কিছু মৌলিক দক্ষতা ও গুণাবলির সঙ্গে পরিচিত হব।

সূক্ষ্মচিন্তণ দক্ষতা: কোনো কিছু গভীরভাবে চিন্তা করাই হলো সূক্ষ্মচিন্তন। পেশাগত জীবনে 'কী, কেন, কীভাবে' ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে খুঁজে বের করা এবং কোনো ঘটনার খুঁটিনাটি খুব ভালোভাবে করতে পারার দক্ষতা অর্জন খুব জরুরি। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয় ও ঘটনা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়। তা না হলে অনেক সময় বড় ধরনের ভুল হয়ে যায়।

সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা: পেশার কাজে যেকোনো সময় সমস্যায় বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। কিংবা এমন হতে পারে, সমস্যার সমাধান করাই হলো পেশাটির মূল কাজ। সেক্ষেত্রে সমস্যার-সংশ্লিষ্ট সবকিছু বিচক্ষণতার সঙ্গে দেখতে হবে এবং নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। সম্ভাব্য উপায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর সমাধানটিকে বেছে নিতে হবে। এভাবে সমস্যাটির সমাধান করতে হবে।

যোগাযোগ ও সহযোগিতামূলক দক্ষতা: পেশাগত কাজে কখনো দলে আবার কখনো কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজন হয়। এজন্য পারস্পরিক মর্যাদা বজায় রেখে কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ তৈরির দক্ষতা অর্জন করা খুব জরুরি। যেকোনো কাজে নিজে থেকেই অন্যকে সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে হবে। দলগতভাবে কিছু করার ক্ষেত্রে সহমর্মিতা, জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।

সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীমূলক চিন্তন দক্ষতা: নতুনভাবে বা ভিন্নভাবে কোনো কিছু চিন্তা করা, অর্থাৎ প্রথাগত কাঠামোর বাইরে ভাবতে পারার দক্ষতাই সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা নামে পরিচিত। আগামীর দিনগুলোতে এই ধরনের চিন্তন দক্ষতা পেশাগত অভিযোজনে ব্যাপক সহায়তা করবে। যেকোনো কিছু নতুনভাবে প্রকাশ করা, প্রদর্শন করা কিংবা নতুন আইডিয়া দেওয়া ইত্যাদি অনুশীলনের মাধ্যমে এই ধরনের দক্ষতার উন্নয়ন করা যেতে পারে।

চাপ মোকাবিলার দক্ষতা: কর্মক্ষেত্রে আবেগ ও মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে পারা গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। দুশ্চিন্তা, মনঃকষ্ট, কাজের চাপ ইত্যাদি আমাদের শারীরিক কর্মক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এ কারণে মানসিক চাপের উৎস কী, কেন এই চাপ তা খুঁজে বের করতে হবে। 'কোনো অবস্থাই স্থায়ী নয়, খুব শীঘ্রই এই অবস্থা কেটে যাবে' এভাবে নিজেকে বোঝাতে হবে, মনকে শান্ত থাকার কথা বারবার বলতে হবে- এভাবে মনোবল বৃদ্ধির মাধ্যমে চাপ মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে।

গাণিতিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা: যেকোনো দক্ষতা অর্জনের পূর্বশর্ত হলো যৌক্তিকভাবে চিন্তা করা, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত থাকা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারা। বাস্তব জীবনে নিয়মিত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা, হিসাব-নিকাশ রাখা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মাধ্যমে আমরা গাণিতিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে পারি। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সব সময় নিজ উদ্যোগে হালনাগাদ প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

আত্মসচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তা: নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকাই হলো আত্মসচেতনতা। নিজের জন্য কোন কাজটি ভালো হবে, কোনটি ভালো নয়, কিংবা কী করছি, কেন করছি, কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, কাজটিতে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না, ইত্যাদি সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি থাকাই হলো আত্মসচেতনতা। এই দিকগুলো বিবেচনায় রেখে নিজের ওপর আস্থা তৈরি করতে হবে। যত বাধাই আসুক না কেন, 'আমি পারব, আমার পক্ষেই করা সম্ভব'-এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিচল প্রতিজ্ঞা অর্থাৎ মানসিক দৃঢ়তাও থাকতে হবে।

সততা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক মূল্যবোধ: পরিবর্তন যা কিছুই আসবে, তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ইতিবাচক মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা খুব জরুরি। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সততা ও মূল্যবোধের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, নিয়মানুবর্তিতা, কাজে স্বচ্ছতা ও সক্রিয়তা এবং পেশার জন্য নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে চলা ইত্যাদি 'পেশাগত নৈতিকতা' নামে পরিচিত। আমরা ভবিষ্যতের যে পেশাতেই যাই না কেন, এগুলো অর্জন ও অনুসরণ ছাড়া কোনোভাবেই সফল হওয়া সম্ভব নয়।

নিজেকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করি

আমরা এতক্ষণ যেসব দক্ষতা ও গুণাবলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সেগুলো মৌলিক দক্ষতা। কিন্তু পেশাগত সাফল্য বা ক্যারিয়ার গঠনের জন্য এগুলোর পাশাপাশি পেশা-সংশ্লিষ্ট কিছু যোগ্যতার উন্নয়ন জরুরি; যেমন:

শিক্ষাগত যোগ্যতা

পেশাগত দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রথমেই যা আসে, তা হলো চাহিদামাফিক সঠিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা। পেশার ধরন অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতার (এসএসসি, এইচএসসি, বিএ (সম্মান), এমএ ইত্যাদি ডিগ্রীর পাশাপাশি পেশা-সংশ্লিষ্ট নিবন্ধনপ্রাপ্ত কোর্স, পেশাগত কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো কোর্স ইত্যাদি অর্জন করতে হবে।

অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলন

পেশার দক্ষতা অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেশার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য আমাদের উক্ত পেশা-সংশ্লিষ্ট কাজ করতে হবে। এর ফলে আমাদের মধ্যে সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা, সময়ের সদ্ব্যবহার, সহযোগিতা, পরিকল্পনা এবং আর্থিক সাশ্রয় করে কাজ করা ইত্যাদি দক্ষতা অর্জিত হবে।

প্রশিক্ষণ

পেশার মৌলিক দক্ষতা অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশিক্ষণ। এটি পেশায় যোগদানের আগেও নেওয়া যায় এবং পেশায় যোগদান করেও নেওয়া যায়। পেশাগত কোর্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, অনলাইন কোর্স ও বিভিন্ন অনলাইন সামগ্রী পাঠ ও অনুশীলন করেও প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে।

হালনাগাদ (আপ টু ডেট) থাকা

সব সময় আপ টু ডেট থাকতে হবে, অর্থাৎ আমাদের পছন্দের পেশায় সর্বশেষ কী পরিবর্তন এসেছে, নতুন কী যুক্ত হচ্ছে, তা সব সময় জানা থাকতে হবে।

পেশাগত সংস্থার সদস্য

আমরা যে পেশায় নিজেকে দেখতে চাই, সে পেশা সংশ্লিষ্ট যেকোনো একটা পেশাগত সংস্থার সদস্য হতে পারি, এতে আমাদের দক্ষতা যেমন বাড়বে, অন্যদিকে চাকরি বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও সুযোগ বাড়বে।

স্বশিখন বা সেলফ লার্নিং

পেশার মৌলিক দক্ষতা অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সেলফ লার্নিং। আমরা অনলাইন সামগ্রী, প্রশ্নোত্তর ওয়েবসাইট, টিউটোরিয়াল, উইকি, ব্লগ বা পেশা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নিজে নিজে শিখতে পারি। এই মুহূর্তে আমরা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে জানি না আগামীতে নিজেকে যে পেশায় দেখতে চাই। তার দক্ষতার ধরন কেমন হবে। তাই স্ব-শিখন অভ্যাস গড়ে তোলা খুব জরুরি।

 

ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের যে কৌশলগুলো মনে রাখা প্রয়োজন

বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ নানা উপায়ে, নানা কৌশলে দক্ষতা অর্জন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বাজায় রাখে। আমরাও যদি পরিবর্তিত বিশ্বে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তাহলে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে পরিবর্তন আনতে হবে। দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি রাখতে হবে। যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন সহজ বিষয় নয় যদি সদিচ্ছা, পরিকল্পনা এবং আকাঙ্ক্ষা না থাকে। দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কয়েকটি অনেকেই অনুসরণ করে থাকে। কৌশলগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।

১. নিজের আগ্রহ বা কৌতূহল

যে বিষয় আমাকে আগ্রহী বা কৌতূহলী করে, সেটিই মনোযোগ দিয়ে শেখা বুদ্ধিমানের কাজ। গবেষণায় দেখা গেছে, যে কাজগুলো আমাদের ভালো লাগে, আনন্দ দেয়, সে কাজ বা দক্ষতা আমরা দ্রুত শিখতে পারি। তাই দক্ষতা অর্জনের শুরুতেই আমাদের নিজের আগ্রহের বিষয়টি নির্বাচন করে নিতে হবে।

২. অনেক বিষয় নয়, একটি দক্ষতা নিয়ে কাজ করা

পেশাগত দক্ষতা অর্জন যেহেতু পরিশ্রম এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই অনেকগুলো দক্ষতা যদি একসঙ্গে অর্জনের চেষ্টা করি, তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। ফলে এ থেকে আমাদের হতাশা তৈরি হতে পারে। তাই আগ্রহের দিকে লক্ষ্য রেখে যে দক্ষতাটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

৩. সময় অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়াকে ভাগ করে নেওয়া

পড়াশোনা, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং, দক্ষতা অর্জন আরও কত কী আমাদের দৈনন্দিন কর্মপরিকল্পনায় থাকে। তাই সময়ের একটি পরিকল্পনা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতটুকু অর্জন করতে চাই, তার লক্ষ্য বা টার্গেট থাকা জরুরি। তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কী শিখলাম, কতটুকু শিখলাম তা পরিমাপ করা সম্ভব হবে। নিজের অবস্থান বুঝে নিয়ে পরবর্তী ধাপের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা সহজ হবে।

পুরো দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়াটিকে ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করে নিতে হবে। তারপর অগ্রাধিকার অনুযায়ী একটি দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অনেক সময় আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই কোনটা আগে করব বা কোনটা পরে করব, সেদিক থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দক্ষতা কতটুকু অর্জন করব সেদিকে নজর দিতে হবে। এজন্য পুরো দক্ষতা অর্জন প্রক্রিয়াটিকে ভাগ করে নেওয়া যায়। কোন সময়সীমার মধ্যে দক্ষতার কোন স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তার জন্য একেকটি মাইলফলক বা মাইলস্টোন নির্দিষ্ট করে নেওয়া যায়।

৪. ডিভাইস বা অন্যান্য সামগ্রী হাতের কাছে রাখা

দক্ষতা অর্জনের জন্য অনেক সময় ডিভাইস বা অন্যান্য উপকরণ প্রয়োজন হতে পারে। সে উপকরণগুলো আগে থেকেই হাতের কাছে রেখে দক্ষতা অর্জনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। আমরা অনেক সময় ভাষা শিখতে চাই, তাই ভাষা শেখার প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন: বই, অ্যাপ, সহায়তাকারী ইত্যাদি আগে থেকে সংগ্রহ করে নিলে দক্ষতা অর্জন কার্যকর হয়।

৫. অনুশীলনের অদৃশ্য দেয়াল দূরে রাখা

অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা দক্ষতা অর্জন করে থাকি। কিন্তু অনেক সময় অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল বা বাধা তৈরি হয়। তাই প্রযুক্তি, স্মার্টফোন, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পারিবারিক ও মানসিক চাপ অথবা অন্য কোনো কিছু বাধা হয়ে যেন না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নিজেই নিজের পরিবেশকে সাজিয়ে নিতে হবে, তাতে নিয়মিত অনুশীলন অনেক সহজ হবে।

৬. একটু সময় বরাদ্দ রাখা

পারিবারিক কাজে অংশগ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত একাডেমিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। তাই একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করে অনুশীলনের অভ্যাস করতে হবে। সময়টাকে ভাগ করে নেওয়া জরুরি। কারণ, অনেক কাজেই আমাদের সময় ব্যয় হচ্ছে, যা তেমন প্রয়োজনীয় নয়। তাই সময়টিকে অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য।

৭. অল্প করে শুরু করা

কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের শুরুর দিকে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হই এবং হতাশ হয়ে যাই। তখন ধৈর্য ধারণ করে শুরুটা করতে হবে, সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর দেখা যাবে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অল্প অল্প করে করা, বিরতি নেওয়া এবং চার-পাঁচ ধাপে অনুশীলন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৮. নিজেই নিজেকে মেপে দেখি

যেকোনো কাজের গতি, ফলাফল কিংবা এর প্রভাব আমাদের কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেয়। ভালো প্রতিফলন দেখতে পেলে আমরা সেই কাজটি আবার করতে চাই। যেমন: নতুন কোনো ভাষা শেখার সময় নিজের পড়ার, শোনার বা বলার অগ্রগতি রেকর্ড করে শুনলে বোঝা যায়, দক্ষতা অর্জন কোন পর্যায়ে আছে। এভাবেই নিজেকে পরিমাপের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে হয়।

দক্ষতা অনুশীলনের সময় আমরা শুরুর দিকে নিখুঁত করার চেষ্টা করে থাকি। ফলে কোনো কারণে নিখুঁত না হলে আসতে পারে হতাশা। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য মনোযোগ দিতে হবে অনুশীলনের পরিমাণ এবং গতির ওপর। পরিমাপ করে দেখতে হবে কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি এবং গতি কেমন ছিল। ভালো কিংবা মোটামুটি ভালো অথবা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পারলে ধরে নিতে হবে আমাদের গতি বাড়াতে হবে।

ক্যারিয়ার প্ল্যান করি নিজেকে এগিয়ে রাখি

নিশ্চয়ই আমরা এখন ক্যারিয়ার প্ল্যান করার জন্য তৈরি। চলো তার আগে একটু বুঝে নিই ক্যারিয়ার প্ল্যান কী এবং কীভাবে ক্যারিয়ার প্ল্যান করতে হয়। ক্যারিয়ার প্ল্যান হলো, একটি প্রক্রিয়া যা আমার নিজের লক্ষ্য, স্বপ্ন, সামর্থ্য, দক্ষতা, আগ্রহ ও দৃষটিভঙ্গি ও মূল্যবোধের আলোকে একটি নির্দিষ্ট পথ বা লক্ষ্য নির্ণয় করতে সাহায্য করে। এটি একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা, যেখানে অনেকগুলো মাইলস্টোন নির্ধারণ করা থাকে এবং তা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ধাপে ধাপে সহায়তা করে।

ক্যারিয়ারে সফল হতে হলে পছন্দের পেশার দক্ষতা, প্রযুক্তিগত সামর্থ্য এবং কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে গবেষকরা দেখিয়েছেন সফট স্কিলস মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।

আমরা সবাই স্বপ্ন দেখতে বা পরিকল্পনা করতে পছন্দ করি, সুতরাং এই স্বপ্ন বা পছন্দ নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের একটি পরিকল্পনা তৈরি করব। এটি একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হতে হবে যেখানে লক্ষ্য, সময়সূচি এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর ধাপগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা এবং অনুসরণ করে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করব। মনে রাখব, এটি একটি পরীক্ষিত প্রক্রিয়া। তাই পরিকল্পনা যদি সঠিকভাবে করা যায়, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ। যদি প্রয়োজন মনে করো, তাহলে একজন ক্যারিয়ার কাউন্সেলর অথবা তোমার শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারো।

 

ক্যারিয়ারের ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও মোকাবিলা করার উপায়

কেস ১: জহির সাহেব কয়েকজন সহকর্মীর পরামর্শে জমানো টাকায় একটা ফ্লাট বুকিং দিলেন। বছর দুয়েকের মধ্যেই তাদের ফ্লাটের কাজ সম্পন্ন হয় এবং জহির সাহেব পরিবার নিয়ে ফ্লাটে উঠেন। কিন্তু কিছুদিন পর তারা নোটিশ পেলেন সিটির নকশা অনুযায়ী তাদের দালানটি নির্মাণ করা হয়নি। দালানের অধিকাংশ অংশ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন জমিতে নির্মিত হয়েছে, ফলে এটি শীঘ্রই ভেঙ্গে দেওয়া হবে। নোটিশটি পেয়ে জহির সাহেবের বাড়ির সব ফ্লাটের মালিকরাই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়লেন।

কেস ২: অপর্ণা ঘোষের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হলে অবসরে চলে আসেন। ফলে একসাথে পাওয়া পেনশনের টাকাগুলো তিনি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্র খুঁজতে শুরু করেন। আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে তিনি অধিকাংশ অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ছয়মাসের মধ্যেই শেয়ার বাজারে শুরু হয় দরপতন; তার মূলধন প্রায় তিনভাগই হারিয়ে যায়। এই অবস্থায় অপর্ণা দিশেহারা হয়ে পড়লেন।

কেস ৩: উষা চাকমা রাংগামাটি থেকে কাপড় এনে চমৎকার নকশায় পোশাক তৈরি করেন। চট্টগ্রাম শহরে তার তৈরি পোশাকের ব্যাপক চাহিদা। তাই একটি সুনামধন্য শপিং কমপ্লেক্সে একটি শোরুম চালু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি টের পান, এখানে বৈদ্যুতিক সংযোগে ত্রুটি রয়েছে। পাশাপাশি অগ্নি নির্বাপণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথাযথ নেই, ফলে সবসময় তিনি দোকানের কর্মীদের নিয়ে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

জেমস ক্যামেরন ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পছন্দ করতেন এবং পড়তেন। বাড়িতে এবং স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় সাইন্স ফিকশনের পাতায় থাকতো তার মনোযোগ। সমুদ্রের তলদেশ ঘুরে বেড়ানো ছিল তার শখ। এই শখ তাকে টেনে নিয়ে যায় উত্তর আটলান্টিকের আড়াই মাইল গভীরে, সত্যিকারের টাইটানিকের সামনে। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি তৈরি করেন টাইটানিক সিনেমা, যা একটি ব্যাপক সাফল্যের মুখ দেখে একসময়। তাই তিনি প্রায়ই তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রাখো। ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করো না।

শিল্পকলা আর অভিযানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করতে শেখাটা জরুরি। কারণ, এখানে বিশ্বাস করে অনেক বড় বড় ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি না নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা যায় না। তাই ব্যর্থতাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কিন্তু ঝুঁকি নিতে ইতস্তত করলে চলবে না। ব্যর্থ হলে হতে পারো, কিন্তু কখনো কোনো কাজকে ভয় পেয়ো না'। জেমস ক্যামেরনের মতো পৃথিবীর প্রায় সব সফল ব্যক্তিদের জীবনে ক্যারিয়ার গঠনের গল্পটা ঠিক একইরকম। তাই ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির একটা বড় ভূমিকা থাকে। আমাদের সফল ক্যারিয়ারের স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রচন্ড আগ্রহ। 'আমি পারব'- এইরকম প্রবল প্রতিজ্ঞা ক্যারিয়ার তৈরির পথকে বাধামুক্ত করতে সহায়তা করে। তাই আমরা সবাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু করব স্বপ্নের ক্যারিয়ারের যাত্রা।

আমরা অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে চাপ মোকাবিলা, কার্যকর যোগাযোগের কৌশল, আত্মবিশ্বাস তৈরির কৌশল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। (প্রয়োজনে www.nctb.gov.bd ওয়েবসাইটের পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকে দেখে নেওয়া যেতে পারে) উক্ত কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য আমরা নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণের চর্চা, স্ট্রেস রিলিফ মিউজিক, ইয়োগা, মেডিটেশন, স্ট্রেস রিলিজ এক্সারসাইজ ইত্যাদির মাধমেও নিজেকে মানসিকভাবে আগামীর কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে।

আমার ক্যারিয়ার

আমরা অনেক ধরনের পেশার পরিচয় পেয়েছি। এবার নিজের জন্য পেশা নির্বাচনের পালা। আগামীর জন্য যা কিছুই আমরা প্রত্যাশা করি না কেন, সেখানে পৌঁছানোর পথটা কিন্তু অন্য কেউ তৈরি করে দিবে না। নিজের পথ নিজেকেই সাজিয়ে নিতে হবে। পৃথিবী, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং পরিবার এসব কিছুকে বিবেচনায় রেখে আমাদের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পথে পাড়ি জমাতে হবে। আমরা জানি, আগামীর পেশাগুলোতে শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ কৃত্রিম সমাজ নয়, সহমর্মী ও মানবিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও থাকতে হবে সবার। সেইসাথে আমাদের সবার গন্তব্য হওয়া চাই- একটা সবুজ স্বপ্নময় পৃথিবীর পথে। সেজন্যে আমাদের চিন্তাকে করতে হবে উন্মুক্ত; ভাবতে হবে ভিন্নভাবে, ভিন্ন মাত্রায়, সৃজনশীল উপায়ে! নতুন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, সর্বক্ষন নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে। তাহলেই আমরা নিজেদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে পারব। এসো, আমরা সবাই আগামীর জন্য সুন্দর ও ঝুঁকিমুক্ত যাত্রা নিশ্চিত করতে চমৎকার পরিকল্পনা করি। নিষ্ঠা, সততা ও শ্রম দিয়ে তা বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এবং বেছে নিই নিজের পথ।

আমরা সবাই স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে চাই। আমাদের স্বপ্নগুলো সত্যি করার পথটাও সব সময় সুন্দর ও মসৃণ দেখতে চাই। কিন্তু বাস্তবে তা নাও হতে পারে। তাই বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নিজের পছন্দ অনুযায়ী চমৎকার পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে সুন্দর আগামীর জন্য। যতই ঝড় কিংবা ঝুঁকি আসুক, নিজেকে অবিচল রেখে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সব মোকাবিলা করব আমরা। নিজের পছন্দের ক্যারিয়ারে সফল যাত্রার পাশাপাশি সবাই মিলে একটা সুন্দর আগামী গড়ে তুলব। যে আগামীতে থাকবে উদার, মুক্ত ও সবুজ পৃথিবীর হাতছানি! কিশোর কবি সুকান্তের মতো তাই বলি-

স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য,

বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ!

হে সাথী, ফসলে শুনেছ প্রাণের গান?

দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান।

Content added || updated By
Promotion